Wednesday, August 11, 2021

কোভিড: বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আবারও একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড ছুঁয়েছে, প্রাণহানি ২৩ হাজার ছাড়িয়েছে

গত ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে যারা মারা গেছেণ, তাদের মধ্যে ১৫৪ জন পুরুষ ছিলেন আর ১১০ জন নারী। এর মধ্যে বাসায় ১০ জন, আর বাকি সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ হাজার ৪১৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে এবং পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৫৪। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ১৪, ৯০৩ জন । বাংলাদেশে গত বছরের মার্চের ৮ তারিখে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছিলো স্বাস্থ্য বিভাগ। এরপরের দুই মাস দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা তিন অংকের মধ্যে থাকলেও সেটা বাড়তে বাড়তে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর বেশ কিছুদিন দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা কমতে কমতে এক পর্যায়ে তিনশো'র ঘরে নেমে এসেছিল। তবে চলতি বছর মার্চের শুরু থেকেই শনাক্তে ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়। চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাসপাতালগুলোর ওপর যে হারে চাপ বাড়ছে, তাতে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে ব্যাপক হারে। রাজধানী ঢাকায় অনেক কোভিড-১৯ রোগী হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারছেন না -এমন অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কারণে হাসপাতালগুলো ইতোমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে। চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাসপাতালগুলোর ওপর যে হারে চাপ বাড়ছে, তাতে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় গত ২৪ ঘন্টায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার জন। একদিনে মৃত্যু হয়েছে ৫৯ জনের। ঢাকায় একের পর এক সরকারি হাসপাতালে ঘুরেও একজন যুবক তার বাবাকে ভর্তি করাতে পারেননি। তাদের বাড়ি বগুড়ায়। সেখানে তিনদিন আগে তার বাবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয় এবং শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়। তখন অক্সিজেন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে তিনি তার বাবাকে ঢাকায় এনে একটি শয্যার জন্য হাসপাতাল হাসপাতালে ঘুরতে থাকেন। সরকারি হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে তিনি তার বাবাকে ভর্তি করিয়েছেন। সেখানেও তার ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে। নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এই যুবক কোভিড-১৯ আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে ঢাকায় হাসপাতালের ভর্তি করনোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। "ঢাকাতে প্রায় আট দশটা হাসপাতালকে নক করেছি। সবাই বলতেছে, সিট ফাঁকা নেই। এর মধ্যে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে সিট হবে বলে কনফার্ম করলো। কিন্তু যাওয়ার পরে ওরা বলতেছে, ওদের ওখানে ইয়োলো জোনে বা নির্ধারিত সাধারণ ওয়ার্ডে কোন সিট খালি নাই।" তিনি আরও বলেন, "আরেকটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করার পর সেখানে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। তারা রোগীর অবস্থা না জেনেই সিসিইউতে ভর্তি করলো। কিন্তু তার সিসিইউ-র দরকার ছিল না। তারা বললো, সাধারণ সিট নাই। সিসিইউতেই রোগী রাখতে হবে। তখন আমরা আরেকটা প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে ভর্তি করলাম" বলেন ঐ যুবক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই গৃহিনী জানিয়েছেন, তার স্বামীর মুমুর্ষ অবস্থায় আইসিইউতে নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু হাসপাতালটিতে আইসিইউর ১৬টি শয্যাতেই রোগী থাকার কারণে তাদের অন্য কোন হাসপাতালে রোগীকে নিতে বলা হয়েছে। তারা টাকার অভাবে বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন না। এদিকে, হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরাও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ঢাকার একটি হাসপাতাল কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক নাদিরা হক বেসামাল পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। "হঠাৎ করে রোগীর ফ্লোটা বেড়ে গেছে আমাদের হাসপাতালে। বর্তমানে আমাদের বেডই খালি নাই। আমাদের আইসিইউতে ১৬টি বেডেই রোগী আছে। অনেক কাজের চাপ। "প্রচুর রোগী আসছে এবং অনেক রোগী আমাদের বাইরে থেকেও টেলিফোন করছে আইসিইউ শয্যার জন্য, যাদের আমরা বেড দিতে পারছি না। আমাদের ওয়ার্ডেও বেশ কিছু ক্রিটিক্যাল রোগী আছে, যারা প্রতি মিনিটে ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন নিচ্ছেন। এদেরও অনেকের আইসিইউ সাপোর্ট দরকার। কিন্তু আমরা দিতে পারছি না" বলেন নাদিরা হক। ঢাকায় কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সরকারি ১০টি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে ১০৪টি। এর মধ্যে মাত্র চারটি শয্যা খালি ছিল গত ২৪ ঘন্টায়। আর নির্ধারিত বেসরকারি ৯টি হাসপাতালে ৩৭৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি ছিল ৪৭টি। বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার জন্য বড় অংকের অর্থ গুণতে হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ৩৩টি জেলায় সংক্রমণ দ্রুতহারে বাড়ছে। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণের যে হার তার ৪০ শতাশেরও বেশি রোগী ঢাকাতেই। একটি বেসকারি হাসপাতালের কর্ণধার ড: লেলিন চৌধুরী বলেছেন, ঢাকার বাইরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো বাদ দিয়ে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা এবং আইসিইউ ব্যবস্থাপনা উন্নত না হওয়ায় অনেক কোভিড১৯ রোগী চিকাৎসার জন্য ঢাকায় আসছে। পরিস্থিতি সামলাতে এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হলে চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়তে পারে বলে তিনি আশংকা করেন। "হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ পূর্ণ সীমা অতিক্রম করার পর্যায়ে এসেছে। যদি এখনই বিষয়টাকে সামাল দেয়া না যায়, তাহলে চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।" তিনি মনে করেন, গত বছর করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কার পর চিকিৎসা ব্যবস্থায় অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সুবিধা কিছুটা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তারপরে যে পরিমাণে বাড়ানো দরকার ছিল-তা হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অতিরিক্ত ১০টি আইসিইউ শয্যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেছেন, ঢাকা সরকারি হাসপাতালগুলোতে আড়াই হাজার সাধারণ শয্যা এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো এক হাজারের বেশি শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা তারা নিয়েছেন। একইসাথে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ভয়াবহতার ইঙ্গিতও এসেছে। "করোনা গত এক সপ্তাহ যাবৎ ব্যাপকহারে বাড়ছে এবং লাফায়ে লাফায়ে বেড়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যুর হারও বেড়ে গেছে। প্রতিদিন যদি পাঁচ হাজার করে শনাক্ত হয়, আর তার একটা অংশ যদি হাসপাতালে আসে, তাহলে হাসপাতালে জায়গা করা সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যেই হাসপাতালগুলো প্রায় ভরে গেছে।" মন্ত্রী বলেছেন, "আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, হাসপাতালের বেড বাড়িয়ে আমরা কিন্তু রোগী সংকুলান করতে পারবো না। উৎপত্তি স্থলগুলোকে যদি আমরা বন্ধ না করি লাভ হবে না। কারণ ঢাকাতে দেড় দুই কোটি মানুষ বাস করে। ফলে পুরো ঢাকা শহরকেই হাসপাতালে কনভার্ট করলেও কিন্তু রোগী সংকুলান হবে না।" হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে করোনাভাইরাসে প্রতিরোধের ব্যাপারে জোর দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। সরকারও ১৮ দফা নির্দেশনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ রয়েছে।